আবৃত্তি প্রাচীন শব্দ” পৌরানিক কাল থেকে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রায় তিন হাজার বছর আগে এই শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ ছিল । শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ- বারংবার পাঠ। আ পূর্বক বৃৎ ধাতু ক্তি প্রত্যয়। প্র, পরা, অপ, সম ইত্যাদি যে বিশটি উপসর্গ বাংলায় পাওয়া যায়, তার একটি হল আ। আ-এর অনেক অর্থ। আ মানে সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে। বৃৎ ধাতুর অর্থ হওয়া বা পড়া ।

আবৃত্তি প্রাচীন হয় এরকম- সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে যা পঠিত বা উচ্চারিত। কবিতা বার বার পড়া একজন ভালো আবৃত্তিশিল্পী হবার প্রথম শর্ত। কবির কবিতা বা লেখকের লেখাকে (গদ্য) বারংবার পাঠের মাধ্যমে লেখাটির সঠিক ভাব, অর্থ, উদ্দেশ্যে, প্রেক্ষাপট হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে তারপর বারংবার অভ্যাস এর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হয় প্রতিটি শব্দের সঠিক উচ্চারণ, প্রতিটি কথার অর্থের সঠিক ভাব, প্রতিটি লাইনের সঠিক উচ্চারণ ছন্দ-তাল। কণ্ঠস্বরের সঠিক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে শ্রোতার মনে ছবির মতো ফুটে ওঠে।কবিতা জীবনের কথা বলে। আর আবৃত্তি তাতে রঙ দেয়। তাই খেয়াল রাখতে হবে রঙ যেন বেশি হয়ে না যায়। আবার ফ্যাকাসেও না হয়ে পড়ে। দুটোতেই সমস্যা।

শ্রোতার মনের ক্যানভাসে সঠিক ছবি ফুটে উঠবে না। আবৃত্তিতে অভিনয় আসে প্রছন্ন ছায়ার মতো। অভিনয় প্রকট হলে আবৃত্তি তার রূপ হারায়, কাব্যিকতা থেকে নাট্যিকতায় রূপান্তর হয়ে আবৃত্তিতে কৃত্রিমতা এনে এর সৌন্দর্য হারায়। একইভাবে আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রেও, আবৃত্তিতে ভাবের প্রকাশ আবেগ দিয়েই ঘটাতে হয় কিন্তু অতিরঞ্জণ হলেই সৌন্দর্য হারায়।

পরিমিতি বোধ এবং মাত্রা নিয়ন্ত্রণেই একজন আবৃত্তিশিল্পীর যত মুন্সিয়ানা। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই পরিমিত বোধ জন্মায়। প্রাত্যহিক জীবনের ওঠাপড়াই মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। আবৃত্তি শিল্পরূপ পায় যখন কবিতার শব্দগুলোকে লব্ধ অভিজ্ঞতার প্রক্ষিতে পরিশীলিতভাবে শিল্পের সাথে জুড়ে দেওয়া যায়। কবিতা তো ভাষার করসত নয়, চিন্তার পরিচর্যাও।

আবৃত্তিশিল্পীকে হতে হবে অনুভূতি প্রবণ। কবিতার বোধ ও অন্তর্নিহিত ভাবকে উপলব্ধি আবৃত্তিশিল্পীর জন্য অপরিহার্য। গভীর উপলব্ধি যে কোন শিল্পের তত্ত্ব, উপাত্ত ও নন্দনবোধের পূর্বশর্ত। বিষয়ের গভীর অনুধ্যান ও মর্মোদ্ধার ছাড়া আবৃত্তির শিল্পশৈলী ও রূপ নির্মাণ অসম্ভব। আবৃত্তিকার লেখক বা কবির সঙ্গে শ্রোতার সরাসরি সংযোগ ঘটিয়ে দেন, কিন্তু তিনি লেখক বা কবির ধারক-বাহক কিংবা প্রচারকও নন।

একজন সার্থক আবৃত্তিকার যখন যে কবির বা লেখকের লেখা আবৃত্তি করেন তখন তিনি সেই কবি বা লেখককে নিজের অনুভবে নতুন প্রাণ দিয়ে কণ্ঠে তুলে আনেন। আবৃত্তিশিল্পীকে কবি বা লেখক সম্পর্কে জানতে হবে, তাঁর জীবন-কর্ম সাথে কেন? কোথায়? এবং কোন প্রেক্ষাপটে কবিতা লেখা হয়েছে সেই সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, তবেই আবৃত্তিশিল্প পরিপূর্ণতা পাবে।কবিতার প্রতিটি শব্দই কিছু অর্থ বহন করে। আর তারই সাথে বহন করে কিছু অনুভূতি। আবৃত্তি সেই অনুভূতিটুকুই পরিমিতভাবে প্রকাশ করে, তাও আবার ওই কয়েকটি নির্দিষ্ট শব্দের মধ্য দিয়েই।

শব্দের রূপ-রস-বোধের সজীব উচ্চারণই আবৃত্তি, আর আবৃত্তির জন্য দরকার অনুশীলন।বলা যায় কঠোর অনুশীলন করে আবৃত্তির মঞ্চে উঠতে হয়। আবৃত্তিকারকে আবৃত্তি করার আগেই বিশুদ্ধ উচ্চারণ, ছন্দ, যতি ও স্বরক্ষেপণ আর শ্বাসপ্রশ্বাসের সঠিক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করে নিতে হয়। ছড়া কিংবা কবিতা আবৃত্তি করার সময় আবৃত্তিকারের উদ্দেশ্য থাকে প্রতিটি ধ্বনি আবেগময় কণ্ঠে শ্রোতার কানে পৌঁছে দেয়া। আবৃত্তি শিল্প অনেক নির্ভর করে ব্যক্তিগত মুনশিয়ানার ওপর।

কোন সময়ে, কোন অনুষ্ঠানে, কোন ধরনের কবিতা, বাছাই করা কবিতার সঙ্গে চারপাশে যা ঘটছে তার যোগ আছে কিনা, আবৃত্তিশিল্পী মঞ্চে দাঁড়িয়ে পারিপার্শিক ঘটনাকে ছুঁতে চেষ্টা করবেন কিনা, সেগুলো আবৃত্তিশিল্পীকে ঠিক করতে হবে। যে মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হবে তার ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়ালে গলা ঠিকমত পৌঁছেবে, সেটা আবৃত্তিশিল্পীকে ভাবতে হবে অর্থাৎ মাইক্রোফোনের সঠিক ব্যবহার জেনেই মঞ্চে উঠতে হবে।

মঞ্চে কীভাবে দাঁড়াবেন, দর্শকদের সামনে কীভাবে নিজেকে তুলে ধরবেন, এমনকি সাজপোশাক নিয়ে ভাবতে হবে, অনুষ্ঠানের সঙ্গে মানানসই পোশাক নির্বাচন করতে হবে। আবৃত্তিশিল্পী নিজের টোটালিকে কীভাবে উপস্থাপিত করবেন সেটা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।

আবৃত্তি মনকে পরিশোধিত করে,পবিত্র করে, অনুপ্রাণিত করে। অমৃতের মত স্বর্গীয় আনন্দ কবিতার মাধ্যমে উপভোগ করা যায়, তা অনভ্যাসে হওয়া সম্ভব নয়- তার জন্য অভ্যাস গঠন করা দরকার। অন্য যে কোন শিক্ষার চেয়ে আবৃত্তি অনেক বেশি অনুশীলন ও সৃষ্টিশীল মন ও মনন দাবি করে।

পাবলিশারঃ শেখ শহীদুল্লাহ্ আল আজাদ. খুলনা জেলা প্রতিনিধি